একদা বাংলার মসলিনের খ্যাতি ছিল জগৎজুড়ে। মোগল সম্রাটের রাজপরিবার থেকে শুরু করে ইউরোপের বড় বড় সাহেব পর্যন্ত গৌরব বোধ করতেন এ মসলিন ব্যবহার করে। মসলিন ছিল মর্যাদার প্রতীক। সূক্ষ্ম মিহি বুনন ও অসাধারণ কারুকাজের জন্যই মসলিনকে তখনকার বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ বস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হতো। মসলিনের মর্যাদা এত বেশি ছিল যে তখনকার সময়ের রাজপরিবার ও বনেদি ধনিক শ্রেণীই বস্ত্র হিসেবে মসলিন ব্যবহার করত। আর এ মসলিন তৈরি হতো কার্পাস তুলা থেকে। কার্পাস সংস্কৃত শব্দ। বাংলা ও হিন্দিতে বলা হয় কাপাস।
কাপাসের গাছকে বলা হয় কাপাসি। আর এ কাপাসি শব্দ থেকেই কাপাসিয়া নামের উৎপত্তি। বর্তমানে গাজীপুর জেলার একটি থানার নাম কাপাসিয়া। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে গ্রিক পণ্ডিত টলেমি কর্তৃক লিখিত গ্রন্থে বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের কথা বর্ণর্না করতে গিয়ে গাজীপুর জেলার সর্বশেষ প্রান্তে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে টোগমা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে কার্পাসিয়াম, আন্তিবোল ও হাতিমাল্লার নাম উল্লেখ রয়েছে। টলেমির কার্পাসিয়াম যে বর্তমানের কাপাসিয়া, এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। এ ছাড়া অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিক আল-ইদ্রিসের বর্ণনায় তাউক নামের নগরের উল্লেখ আছে। টোগমা বা তাউক শব্দ থেকে বর্তমানের টোকনগর শব্দটি এসেছে। আর আন্তিবোল নাম থেকেই আটি ভাওয়াল জায়গার নামকরণ হয়েছে। প্রাচীন কার্পাসিয়াম, টোগমা ও আন্তিবোল এলাকায় উৎপাদিত কার্পাস তুলা ও কার্পাস বস্ত্রের সুখ্যাতি রূপকথার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যের দেশগুলোতে। এর ফলে দলে দলে আরব ও ইউরোপীয় বণিকরা বাংলার এ অঞ্চলে কার্পাসজাত বস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আসতে লাগল। তারা নগদ অর্থ দিয়ে কার্পাস তুলার তৈরি বস্ত্র কিনে নিতে লাগল। আবার কখনো মসলিন বা দামি বস্ত্র হলে স্বর্ণমুদ্রা দিত। বিদেশি বণিকদের চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় বস্ত্রশিল্পীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এ সময় জেলার বেশির ভাগ অধিবাসী নগদ অর্থর্ ও স্বর্ণমুদ্রার লোভে কৃষিকাজ ছেড়ে বস্ত্রশিল্পের উপকরণাদি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আরব ও ইউরোপে কার্পাস বস্ত্রের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলে তাঁতিদের মধ্যে উন্নতমানের বস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। সম্ভবত এ সময়ই এখানকার একেকটি পরিবারে তাঁতে ছোট একাধিক কারখানা গড়ে ওঠে। এ অবস্থায় ভারতীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। কারণ আরব ও ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে তারা পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। ভারতীয় বণিকরা এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বস্ত্রের পরিবর্তে এখানকার কার্পাস তুলা সংগ্রহ করে ভারতে পাঠাতে থাকে। তারপর ভারতের বারানসি, উজ্জয়িনী, শ্রাবস্তী প্রভৃতি শহরে বস্ত্র তৈরি করে বিদেশে পাঠানো হতে থাকে। এর ফলে বাংলার কার্পাসজাত বস্ত্রের পাশাপাশি কার্পাস তুলার চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ভারতীয় বণিকদের তুলার চাহিদা পূরণের জন্য গাজীপুর জেলা ও এর আশপাশে কার্পাসের চাষ দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। এমনকি বাড়ির আঙিনায়ও কার্পাসের চাষ করে গৃহবধূরাও দু-পয়সা উপার্জন করত। হাজার হাজার বছর ধরে বাংলার বস্ত্রশিল্পের ইতিহাসে এ সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ। প্রায় দুই হাজার বছর তাঁত ও মসলিনের স্বর্ণযুগ পার করে ইংরেজ শাসনামলের শেষ দিকে নীল চাষ ও ইংরেজদের অত্যাচারে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় কার্পাস তুলার চাষ। কিন্তু কার্পাস তুলার স্মৃতি ধারণ করে কাপাসিয়া নামটি এখনো টিকে আছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস